1. m.a.roufekhc1@gmail.com : alokitokha :
খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের পোস্টমর্টেম - আলোকিত খাগড়াছড়ি

খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের পোস্টমর্টেম

  • প্রকাশিতঃ শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২০
মো. আবদুর রউফ:
খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম নেই। ২০১৫ সালে সম্মেলনের পর থেকে অদ্যবদি পর্যন্ত জেলা ছাত্রলীগের পরিচিতি সভাটি পর্যন্ত করতে পারেনি তারা। একটি বর্ধিত সভাও হয়নি। এটিকে চরম ব্যর্থতা উল্লেখ করে এখনই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগসহ নতুন কমিটি দাবি করেছেন জেলা ছাত্রলীগ সহ তৃনমূলের নেতাকর্মীরা।
দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে চলে আসা খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের ‘ব্যালেন্স কমিটি’র বৃত্ত ভেঙে ২০১৫ সালের ১ জুন নেতাকর্মীদের সরাসরি ভোটে সভাপতি-সম্পাদক নির্বাচিত হন টিকো চাকমা ও জহির উদ্দিন ফিরোজ। এই নিয়ে সংগঠনের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ছিল। কারণ জেলা ছাত্রলীগের ইতিহাসে এটিই ছিল নেতাকর্মীদের ভোটে নির্বাচিত প্রথম কমিটি। তবে উৎসাহে ভাটা পড়ে।
একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে গৃহদাহ শুরু হয় ছাত্রলীগে। জেলা ছাত্রলীগের সঙ্গে সমন্বহীনতায় দূরত্ব বাড়ে উপজেলা, পৌর, কলেজ ইউনিটগুলোর। ফাটল ধরে ঐক্যে। বাড়তে থাকে মতবিরোধ।
ক্ষোভের মূল কারণ হল- কমিটি গঠনের দীর্ঘ ৫ বছরেও সংগঠনের পরিচিতি ও বর্ধিত সভা করতে না পারা, নতুন ইউনিটের সম্মেলন দিতে না পারা, স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, বিএনপি-জামায়াত শিবিরকে সংগঠনে পুনর্বাসন, দলে বিভক্তি, শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়াসহ বিস্তর অভিযোগ জমেছে সভাপতি টিকো চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন ফিরোজের বিরুদ্ধে।
সভাপতি-সম্পাদকের ফেসবুক রাজনীতি শুরু থেকে দলের সিদ্ধান্তগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে আসছেন সভাপতি-সম্পাদক। সর্বশেষ সভাপতি-সম্পাদকের যৌথ স্বাক্ষরে ফেসবুকে একাধিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরমধ্যে গত ১৪ নভেম্বর দীঘিনালা উপজেলা, দীঘিনালা সরকারি ডিগ্রি কলেজ, মাটিরাঙ্গা উপজেলা, রামগড় উপজেলা ছাত্রলীগের প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটি ঘোষণার দিবাগত রাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মাটিরাঙ্গা উপজেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয় মাটিরাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগ।
এর পরেরদিন ১৫ নভেম্বর বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ ও সংবাদ সম্মেলন করে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষিত কমিটির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় জেলা-উপজেলা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় ঐদিন বিকেলে দীঘিনালা উপজেলা ছাত্রলীগ এবং দীঘিনালা সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয় দীঘিনালা উপজেলা আওয়ামী লীগ। ঐদিনই সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকের যৌথ স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি ভাইরাল হয়। যাতে লেখা ছিল “বাংলাদেশ ছাত্রলীগ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার এক জরুরি সিদ্ধান্ত মতে জানানো যাচ্ছে যে গত ১৪/১১/২০২০ ইং তারিখে নবগঠিত মাটিরাঙ্গা উপজেলা ছাত্রলীগ, রামগড় উপজেলা ছাত্রলীগ, দীঘিনালা উপজেলা ছাত্রলীগ, দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হল। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সকল কার্যক্রম স্থগিত করা হল।”
এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ কলেজ শাখাগুলোকে জেলা শাখার সাংগঠনিক ইউনিট ঘোষণা দেওয়া হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ উপজেলা-কলেজ কমিটি বাতিল করে নতুনভাবে পানছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগ এবং কলেজের আংশিক কমিটি ঘোষণা করার বিষয়টি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন নেতাকর্মীরা। মতামত কিংবা আলোচনা না করায় পানছড়ি ডিগ্রি কলেজের সদ্য ঘোষিত আংশিক কমিটির দুই সহসভাপতি সকন চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা এবং সাধারণ সম্পাদক তমাল বিকাশ ত্রিপুরা পদত্যাগ করেছেন। এরপর পানছড়ি উপজেলায় ছাত্রলীগের সব কর্মকাণ্ড স্থগিত করে আরেকটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে উপজেলা আওয়ামী লীগ।
এর আগে পানছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সম্পাদক স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষিত নতুন কমিটি প্রত্যাখান করার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সন্তান এবং ছাত্রদলের নেতা নিয়ে গঠিত কমিটি তারা গ্রহণ করবেন না।
দীঘিনালা উপজেলা ছাত্রলীগের উপ-পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক অপু চৌধুরী বলেন, “ফেসবুকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমাদের উপজেলার কলেজকে জেলা শাখার সাংগঠনিক ইউনিট ঘোষণা করা হলো, আমাদের কমিটি বাতিল করা হলো। বিবাহিত, অছাত্র এবং মামলার আসামী দিয়ে উপজেলার নতুন কমিটি ঘোষণা করা হলো। কলেজ কমিটির বিষয়ে আমরা কিছুই জানলাম না। কারো সাথে আলাপ আলোচনা না করে দুইজনের এমন সিদ্ধান্ত আমরা মানব না। ইচ্ছে মত তারা সিদ্ধান্ত দিলে আমরা কেন পারব না?”
জেলা ছাত্রলীগের উপ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক তেপান্তর চাকমা অভিযোগ করেন, জেলা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কাউকে না জানিয়েই সভাপতি-সম্পাদক এককভাবে সংগঠন চালাচ্ছেন। ফলে কমিটি গঠনের ৫ বছরেও ছাত্রলীগের একটি সম্মেলনও করা সম্ভব হয়নি। তিনি জেলা কমিটির সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিযোগ তোলে দ্রুত জেলা কমিটি বিলুপ্তের দাবী করেন।
খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক উবিক মোহন ত্রিপুরা বলেন, এ পর্যন্ত যতগুলো প্রেস কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে সে তালিকায় অ-ছাত্র, বিবাহিত, শিবির-ছাত্রদল এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামীদের নাম রয়েছে। তিনি বলেন, মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদ্য ঘোষিত সভাপতি তসলিম উদ্দিন রুবেল চোর সিন্ডিকেটের সদস্য এবং মাদক মামলার আসামী- সে কিছুদিন আগেই জেল হতে বের হয়েছে, সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবু তালেব জহির উদ্দিন ফিরোজের ভাগিনা। সে ফেনীতে শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। দীঘিনালা সদ্য ঘোষিত সভাপতি মোঃ মেহেদী আলম সেনাবাহিনীর চাকুরীচুত্য, সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর খাঁন রাজু অছাত্র, একজন কাঠ ব্যবসায়ী এবং সরকার বাদী মামলার আসামী। দীঘিনালা সরকারি ডিগ্রি কলেজের সভাপতি মোঃ হেলাল ও সাধারণ সম্পাদক আরপিন রাহাদ মানিক তারা দুজনেই বিবাহিত। পানছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মোঃ জাহাঙ্গীর আলম ইউনিয়ন ছাত্রদলের একজন সক্রিয় নেতা। এরকমভাবে রামগড় উপজেলা ও কলেজ কমিটিও একই সূত্রে গাঁথা। সভাপতি-সম্পাদক তাদের হীন স্বার্থে এই কমিটি গুলো ঘোষণা করেছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী। আমরা এদের অপকর্মকে মেনে নিতে পারিনা।
সভাপতি সম্পাদকের এমন কর্মকাণ্ডের পর খাগড়াছড়ি জেলা জুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
১৫ নভেম্বর (রবিবার) দুপুর ১টায় জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে এক সাংবাদ সম্মেলন করে জেলা ছাত্রলীগ। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আলোক ত্রিপুরা বিপন। এ সময় জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাপ্পী চৌধুরী, উবিক মোহন ত্রিপুরা, অর্থ সম্পাদক মোঃ আনোয়ার হোসেন, মহালছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জিয়াউর রহমান, দীঘিনালা উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক বাবলু দে, গুইমারা উপজেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আনন্দ সোম, পানছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শ্রীকান্ত দেব মানিক, মাটিরাঙ্গা উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সালাহ উদ্দিনসহ জেলা, উপজেলা, পৌর ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি আলোক ত্রিপুরা বিপুন বলেন, “সভাপতি-সম্পাদক ফেসবুক রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। ফেসবুকে বিবৃতি ছেড়ে দিয়ে মন চাইলে কমিটি স্থগিত করে, মন চাইলে বাতিল করে। কোন বিষয়ে আজ পর্যন্ত আমাদের ডেকে আলোচনা করেনি। মূলত আর্থিক সুবিধার জন্য তারা আদর্শিক মিল না থাকার পরও যাকে তাকে পদে বসাচ্ছে। পদ থেকে বাদ দিচ্ছে। আমরা বিষয়টি কেন্দ্রে জানিয়েছি। তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।”
এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি টিকো চাকমা বলেন, ছাত্রলীগ নিয়ে জেলায় যা হচ্ছে তা আমার অজান্তে এবং আমার নিয়ন্ত্রণের বাহিরেই হচ্ছে। সম্প্রতি ঘোষিত কমিটিগুলোর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিও আমার টাইম লাইনে প্রকাশ হয়নি। নানা অভিযোগের কারণে গত ১৪ নভেম্বর গঠিত দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা, রামগড় উপজেলা এবং দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তিনি বলেন, আমি জেলা সভাপতি অথচ একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিও আমি প্রকাশ করিনি। বাকিটা এখান থেকেই বুঝে নিতে বলেন তিনি। তবে তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির উচিত দ্রুত নতুন জেলা কমিটির ঘোষণা দেওয়া।”
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী বলেন, “জেলা ছাত্রলীগ নিয়ে যা হচ্ছে তা কাম্য নয়। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের জানানো হয়েছে। তাদেরকেই এর সুরাহা করতে হবে। এ মুহূর্তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকেই সব দায় নিতে হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো সংবাদ